আমাদের খবর এখন আর কেউ জানতে চায় না।
আলহামদুলিলহ, আমি মাহবুবুর রহমান এবং আমার পরিবার এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে। তবে
আগামীকাল সুস্থ থাকতে পারবো কি না সন্দেহ আছে।
আমরা প্রবাসীরা করোনার এই পর্যায়ে বা এখন এখন কেমন আছি, তা আর কেউ জানতে চায় না।
প্রথম প্রথম বিভিন্ন মাধ্যমে ডাক পড়তো আমাদের খবর জানানোর জন্য। এখন সে ডাক কমে
এসেছে। মনে হচ্ছে করোনার সাথে মানুষের বসবাস করা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে এবং
পৃথিবীর মানুষের কাছে আর কোন উপায় নেই, তাই মানুষ বাধ্য হয়েই জীবনের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে
বোবা হয়ে চলছে।
পরিবার-পরিজন নিয়ে দীর্ঘ ১১ মাস প্রকৃতপক্ষে ঘরের মধ্যে বন্দী অবস্থায় আছি আমরা। তবে
মাঝখানে কখনো আশার আলো জ্বলেছে, কখনো নিভেছে। শারীরিক ও স্বপ্নের মৃত্যুও হয়েছে অনেকের
এবং মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে অনেকের নাম।
জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আমাদের। বাচ্চারা হাফ ছেড়ে মুক্ত বাতাসে পাখা মেলে উড়তে চায়,
দিগন্তের ওপাড়ে।
ডেনমার্কে মাঝে মাঝে লকডাউনের বিরুদ্ধে রাস্তায়ও নামছে মানুষ। এটা জীবনের হতাশারই
বহি:প্রকাশ বটে। জনগণ আর পারছে না। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ সব ব্যবসা
প্রতিষ্ঠান বন্ধ দীর্ঘদিন। অতি প্রয়োজনীয় অফিস বাদে সবাই ঘরে বসেই অনলাইনে অফিস করছে।
পরিবার বাদে ৫ জন মানুষের বেশী এক জায়গায়, একসাথে হওয়া নিষেধ। নির্দেশ অমান্য করলে
বাংলাদেশী মুদ্রায় জনপ্রতি প্রায় ৩৫০০০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। আবার একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে
দ্বিত্বীয়বার জরিমানা চক্রহারে বাড়বে।
শুধুমাত্র খাবারের ‘টেক আউট’ দোকানগুলো খোলা। তবে কেউ বসে খেতে পারবে না। যে সকল
ব্যক্তি মার্চ ২০২০ পর্যন্ত ফুলটাইম, মানে ১৬০ ঘন্টা বিশ্রাম বাদে ১৩৭ ঘন্টা কাজ করেছে, তারা
সরকার থেকে ৯০% বেতন পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন।
এখানে সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য একই নিয়ম। ১০০% মানুষকে ট্যাক্সের অধীনে
রেজিষ্টেশন করতে হয় বা হয়ে যায়। সকল মানুষের পার্সোনাল ট্যাক্স ৩৬% থেকে শুরু হয়। তবে যার
বেতন যত বেশী, তার ট্যাক্স ততো বেশী। কেউ কারো চেয়ে ছোট নয়, আইনের কাছে কিংবা
মর্যাদায়।
“নো বডি কেয়ার নো বডি অর সামবডি”- এটাই গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশ্রণের সুফল।
করোনাকালে এখানকার ব্যবসায়ীরা ২০১৯ সালে প্রতিমাসে যে পরিমান ইনকাম করেছে বা ব্যবসা
হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে মার্চ ২০২০ থেকে অদ্যাবধি লোকসানের অংশ সরকার দিচ্ছে। তবে
৮০% এর বেশী নয়। তবুও হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। যার কারণে ডেনমার্কের
জিডিপি ২০২০ সালে মাইনাসে গিয়ে পৌঁছেছে।
ডেনমার্কে প্রায় চার/পাঁচ হাজার বাংলাদেশীর বসবাস। তাদের মধ্যে অনেকেই করোনা ভাইরাসে
আক্রান্ত হয়েছিল বা হচ্ছে। আজ পর্ষন্ত কোন বাংলাদেশী মারা যায়নি। তবে তাদের ব্যবসায় ধস
নেমেছে। অনেকেই কাজ হারিয়ে বর্তমানে কর্মহীন ভাতা নিচ্ছে।
তারপরও সবমিলিয়ে ইউরোপের অন্য দেশের তুলনায় ডেনমার্কের সর্বাঙ্গীণ অবস্থা তুলনামূলকভাবে
ভালো।
একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো কতটা শক্তিশালী এবং তার কি প্রয়োজন হয়, তা করোনা
ভাইরাস প্রতিটি দেশের সরকার প্রধানদের নিশ্চিত বুঝাতে সক্ষম হয়েছে।মানুষ নিশ্চিত এখন স্বীকার
করবে পৃথিবীতে অবিনশ্বর বলে কিছুই নেই। অবিনাশিতাবাদ সূত্রের মতো
পৃথিবীতে শক্তির পরিমান নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয়- শুধু এক রুপ থেকে অন্যরুপে পরির্বতিত হয়।
ডেনমার্কে করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যপারে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব কাজ করছে।
এদেশের সরকারের উপর জনগণের ১০০% আস্থা ও বিশ্বাস আছে। সেটা সরকারী দল কিংবা
বিরোধী দলের যে কেউ হোক না কেন। ক্যাটাগরিভিত্তিক ১৮ বছরের উপরে সকল নাগরিক বিনা
পয়সায় টিকা পাবে। এই টিকা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য ডেনিশ সরকার ২৭ ডিসেম্বর ২০২০
থেকে কার্ষক্রম শুরু করেছে, যা ২৭ জুন ২০২১ পর্ষন্ত চলবে।
তবে মার্চের পরে ধারাবাহিকভাবে সবকিছু নিয়ম মেনে, শর্তসাপেক্ষে খুলবে বলে সংবাদে প্রকাশিত
হয়েছে।
জীবন যেহেতু থেমে থাকে না, তেমনি জীবনের স্বপ্নগুলি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। তাই এভাবেই
বেঁচে থাকবে আমাদের স্বপ্ন ভাঙাগড়া সময়ের সাথে।
মাহবুবুর রহমান, ডেনমার্ক।