সবসময়ই শুনে আসবেন বাঙালিরা ‘ঐতিহ্য’ নিয়ে বেড়ে ওঠা এক জাতি। সেই ১৯ শতকের অবিভক্ত বাংলাই হোক কিংবা বর্তমানের কাঁটাতারের বেড়ায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে থাকা বাংলাই হোক না কেন, সংস্কৃতি- ঐতিহ্য সবকিছুতেই ‘আভিজাত্যের’ কোনো কমতি যেন নেই। ঠিক এই জায়গা থেকেই শুরু হয় ‘বুলবুল’ সিনেমার গল্প।
বুলবুল যেন বাঙ্গালির সেই আভিজাত্যের মুদ্রার অপর এক পিঠ। যে বয়সে গাছে উঠে ফল ছিঁড়ে খাওয়াটাই হওয়া উচিত স্বাভাবিক, সেই বয়সে ভারী গয়না পরে, শাড়ির আচলে চাবির গোছে বেঁধে ‘বড় বউ’ আখ্যা পাওয়াটাই বা কতটুকু সাধে?

এই পুরো চলচ্চিত্রে বুলবুলের বিয়ের প্রথম দিনের ‘দোটানা’, যেখানে নিজের সমবয়সী দেবরকে নিজের বর মনে করা- অনেক বড় এক অংশ মেলে ধরে।
ইন্দ্রনীল, মাহেন্দ্র আর সত্য- ৩ পুরুষের সংসারে ‘ঠাকুর বাড়ির বউ’ সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা দুই নারীর গল্পও ফুটে উঠে এখানে। মানসিকভাবে অসুস্থ এক স্বামী, সেই সাথে বয়সে প্রায় অর্ধেক অন্য এক নারীকে ‘বড় বউ’ সম্মান করা- বিনোদিনীর জন্য সবটাই ছিল অস্তিত্বের সংকট। তাই বুলবুলের অবাধ স্বাধীনতা, ঠাকুরমশাই এর ভালবাসা পাওয়া আর সত্যের সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা- কোনোটাই যেন বিনোদিনীকে ভাল থাকতে দিচ্ছিল না। তাই বার বার বুলবুলকে আটকে রাখার চেষ্টা সেই পায়ে নতুন আংটি পরানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। কখনোবা বিনোদিনীর চাইতো সত্যের বিয়ে ঠিক করতে অথবা, ঠাকুরমশাই এর কানে বুলবুলের নামে কিছু ভালমন্দ শোনাতে।
ঠাকুরমশাই এর চরিত্রগত দিকে দুটো জিনিস স্পষ্ট ছিল। এক, বুলবুলের প্রতি তার নিজের মত ভালবাসা, দুই- আপন ভাইয়ের কারণে বুলবুলের ভালবাসা না পাওয়া। এ দুটো দিকের কারণেই সত্যকে বিলেত পাঠানোর পরও নিজেকে শান্ত করতে পারেনি ইন্দ্রনীল। ফলাফল- পুরুষত্ব প্রকাশের সেই প্রাচীন হাতিয়ার ‘স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার’ ঘটনা দেখা যায় গল্পে।
বুলবুলের পা যখন ক্ষতবিক্ষত, তখনই সিনেমার এক শক্ত চরিত্র ডাক্তার সুদীপ নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করে। তার প্রথম প্রশ্নই থাকে ‘কিভাবে এত আঘাত পেলো বুলবুল?’ যদিও ‘সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে’ এমন ব্যাখ্যা বিশ্বাস করতে পারেনি এই ডাক্তার।

গল্প যখন স্বাভাবিক গতিতেই এগোতে থাকে, তখনই গল্প মোড় নেয় এক ভয়ংকর দিকে। সেই ছোট্ট শিশু থেকে তরুণী- সব বয়সী বুলবুলের প্রতিই মারাত্মক পরিমাণের আকর্ষণ ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন মাহেন্দ্রর। অসুস্থ বুলবুল যখন ব্যান্ডেজ করা পা নিয়ে যন্ত্রণায় কাতড়াচ্ছে, ঠিক তখনই তাকে ধর্ষণ করে এই দেবর। অপার্থিব যন্ত্রণা, দুঃখ, অপমান সবমিলিয়ে নিস্তেজ হতে থাকে বুলবুল, তবুও থামেনা সে। যতক্ষণে শেষ হয় এই ধ্বংসযজ্ঞ, ততক্ষণে নিদারুণ কষ্টে দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে বুলবুল। এরপর?
এরপরের গল্প বলার কিছু নেই। পুরোটাই স্বচ্ছ আকাশের মত পরিষ্কার। তবে বিলেত থেকে ফিরে এসে প্রিয় ভাবীর স্বেচ্ছাচারী আচরণ দেখে তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে সত্য। যেই ঘটনার কোনো ভিত্তি নেই, সেই ফাঁকা জায়গাতেই হাওয়ার ওপর সন্দেহের প্রাসাদ গড়তে শুরু করে সে। বিধবা বিনোদিনীকে ঘরে ফেরানো আর বুলবুলকে নিজের মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া- সবই যেন ছিল সত্যের পরিকল্পনার অংশ।
এই পুরো দৃশ্য বুলবুলের নজর থেকে দেখতে একটি সংলাপই যথেষ্ট- “তোমরা সবাই এক রকম!”
গল্পের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ইন্দ্রনীলের সম্পর্কে বাড়তি কিছু বলার নেই। কিন্তু বলার আছে ডাক্তার সুদীপের বিষয়ে। গল্পের স্তরে স্তরে যেখানের শাঁকচুন্নির হাতে মৃত্যু হয়েছে এমন ঘটনা মাকড়সার জালের মত ছড়াতে থাকে, তখনও খুনের স্থানে উপস্থিত হতে দেখা যায় সুদীপকে।

ইন্দ্রনীল, মাহেন্দ্র এরপর সত্য- একই পরিবারের তিন পুরুষের কাছে যখন শারীরিক কখনোবা মানসিক নির্যাতনে নির্যাতিত বুলবুল, তখন ‘সবাই যে এক নয়’ এমন এক প্রতিচ্ছবি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় সুদীপ।
পুরো চলচ্চিত্র মাত্র দেড় ঘন্টার। লোকেশন, সিনেমাটোগ্রাফি, ‘ড্রেসিং সেন্স’, ডায়লোগ, গল্প বলার ধরণ এমনকী কাস্ট, কোনো কিছুরই কমতি ছিলনা। প্রথম দিকে গল্প বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলেও দ্বিতীয়ার্ধ্বে সব খুবই সহজ এবং সুন্দর।
বুলবুল চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বেঁচে থাকাই যেন একটি বাড়তি আবদার- এমন কিছু কঠিন সত্য। বুলবুলকে ভাবী কিংবা ভালবাসার মানুষ হিসেবে কল্পনা করা সত্য, কখনই বুলবুলকে চিনতে পারেনি। যেখানে, কোনো ধরণের প্রতিদান আশা না করা বন্ধুত্বে আঁকড়ে ধরে রাখা সুদীপ বুলবুলকে সতিকার অর্থেই জানতো এবং বুঝতো।
মাহেন্দ্রর আঘাতে বুলবুলের শরীরে থাকা পৌশাচিক ক্ষতের দাগ মুছতে গিয়ে বিনোদিনী বলেছিল ‘যে সংসার যত বড়, তার গোপনীয়তা তত বেশি’। একইভাবে সে ব্যাখ্যাও করছিল চুপ থাকলে কিভাবে রেশম পাওয়া যাবে, গয়না পাওয়া যাবে, এমনকি মানসম্মানও পাওয়া যাবে। এই দৃশ্যে ‘নারীই অন্য নারীর শত্রু হয়ে দাঁড়ায়’ কথাটি যথার্থ প্রতিফলন ঘটে।

এই সিনেমার ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল কিংবা লেন্স কোথায় ফোকাস করছে তা নজরে আসে ভালভাবেই। রাহুল বোসের অভিনয় একদম ঠাকুরের মতই সম্ভ্রান্ত। পাওলি দাম নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই, সে বরাবরই সব চরিত্রে ‘খাপে খাপ’ ভাবেই মানিয়ে যায়। অবিনাশ তিওয়ারিও অল্প সময়ে ভাল ‘এফোর্ট’ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
তবে প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত অবাক করেই গেছেন তৃপ্তি দিমরি। ভারী নয়, বরং শুভ্র-সুন্দর এবং ছিমছাম সাজে আর তার সুন্দর এক্সপ্রেশনে ছাপিয়ে গেছেন সবাইকে। হাসি থেকে শুরু করে শান্ত দৃষ্টি- কোনোদিকেই কমতি ছিলনা এই অভিনেত্রীর। বুলবুল চরিত্রে আর কেউ হয়তো এত ভাল নিজেকে প্রকাশ করতে পারতোনা।
ডাক্তার সুদীপ চরিত্রে থাকা পরমব্রত নিয়ে নতুন করে বলার ভাষা নেই। ‘কাহানী’ (কাহিনী) এর মাধ্যমে হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রে ঠাঁই নেওয়া এই অভিনয়শিল্পী ‘পারি’ (পরী) এর পর আবারও প্রমাণ করলেন, ভাষা যাই হোক, অভিনয়ের পরিক্ষায় তাকে আটকানোর কিছু নেই।
ছবির পরিচালক ও প্রযোজক, সবার চেষ্টা যে সফল হয়েছে তা বলাই যায়।
‘বুলবুল’ চলচ্চিত্রের সবকিছুই মেনে নেওয়ার মত ছিল। কিন্তু শেষের দৃশ্যে প্রতিশোধের বদলে অনুতপ্ত ঠাকুরমশাইকে দেখতে পেলে হয়তো ষোলআনা পূর্ণতা পেতো এই সিনেমা। গল্প-উপন্যাসের বাইরে এসে একটু ব্যতিক্রমী এক সমাপ্তি একটি বেশিই ভাল বোধ করাতে পারতো দর্শকদের।

এই পুরো চলচ্চিত্রে সেই ১৯ শতকের চিত্র দেখানো হলেও, বর্তমান যুগের সমাজের সাথে এর খুব বেশি পরিবর্তন আসলে হয়-ও-নি। পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের এই সমাজে নারীদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাও যেন পাপ। স্ত্রীকে বশে আনার জন্য পায়ের আঙ্গুলে আংটি পরার এই চল আগের মত চলে গেলেও অদৃশ্য এক শিকল এখনো রয়েছে সবখানে। আভিজাত্যের আড়ালে থাকা অন্যায়কে না করাটাই যেন নারীদের বানিয়ে দেয় পুরুষের শত্রু আর সমাজের চোখে ‘চুড়েইল’ বা ‘শাকচুন্নী’। কিন্তু আসলেই কি তাই?
উত্তর দিয়েছে সুদীপের একটি ডায়লগই- ‘শাকচুন্নী নয়, সে হলো দেবী!’
*কেউ যদি দেখতে চান বলবো অবশ্যই দেখুন। এমন চলচ্চিত্র দেখতে গল্পেরও প্রয়োজন হয়না, শুধু অভিনয় দেখার জন্য হলেও দেখা উচিত। তবে পুরো গল্পে প্রতিটি দৃশ্যে কিছু ‘ইস্টার এগ’ থাকে, একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বুঝবেন। যেমন- বুলবুল গাছে চড়ে আম খেতে ভালবাসতো, বুলবুল পায়ে জুতা পরতে চাইতোনা, এমন কিছু ঘটনা সুন্দরভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে গল্পের সমাপ্তির জন্য হয়তো একটু অস্বস্তি লাগবে, তবে বুলবুলের পরিণতি আপনার মনকে কাঁদাবে।
রেটিং-৭/১০
২ thoughts on “বুলবুল; উনিশ শতকের গল্পে একবিংশ শতকের বাস্তবতা!”
https://prednisonebuyon.com/ – prednisolone weight loss
http://buyneurontine.com/ – Neurontine