বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
Ads

শিক্ষায় মূল্যবোধের সংকট ও আমাদের করণীয়

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। সমাজের মানবিকতা, ন্যায়নিষ্ঠতা ও সভ্যতা কি হবে, তার ভিত্তি গড়ে ওঠে শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা মানুষকে কর্মদক্ষ করে তোলে না; পাশাপাশি সুচিন্তাশীল, দায়িত্ববান ও নৈতিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে মূল্যবোধের সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। এই সংকট শুধু শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা নয়; এটি আমাদের সামগ্রিক সামাজিক ও নৈতিক সংকটেরই প্রতিফলন।আজকের বাস্তবতায় শিক্ষা অনেকাংশেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে নম্বর, সিজিপিএ, সনদ ও চাকরির প্রতিযোগিতায়। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের কাছে শিক্ষা মানে ভালো ফলাফল অর্জন, দ্রুত ডিগ্রি শেষ করা এবং আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। এই লক্ষ্যগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যখন এগুলোই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্যে পরিণত হয়, তখন শিক্ষার প্রকৃত দর্শন হারিয়ে যায়।

ফলস্বরূপ আমরা এমন এক প্রজন্মের মুখোমুখি হচ্ছি, যারা প্রযুক্তিতে দক্ষ, তথ্যসমৃদ্ধ, কিন্তু নৈতিকতা ও মানবিকতায় দুর্বল। পরীক্ষায় নকল, প্রশ্নফাঁস, অ্যাসাইনমেন্টে কপি-পেস্ট, গবেষণায় প্ল্যাজারিজম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসৌজন্যমূলক আচরণ—এসব ঘটনা এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এগুলো নিছক শৃঙ্খলাভঙ্গ নয়, বরং গভীর মূল্যবোধ সংকটের লক্ষণ।শিক্ষায় মূল্যবোধের সংকট বোঝার জন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে পরিবারে। পরিবারই হলো শিশুর প্রথম বিদ্যালয়, বাবা-মা তার প্রথম শিক্ষক। কিন্তু আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, অর্থনৈতিক চাপ ও ভোগবাদী মানসিকতার কারণে পরিবারে নৈতিক শিক্ষার চর্চা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। অনেক অভিভাবক সন্তানের ফলাফল, স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এবং ভবিষ্যৎ চাকরি নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, তার চরিত্র, সততা ও আচরণ নিয়ে ততটা সচেতন নন।এর ফলে শিশুর মনে একটি বিপজ্জনক ধারণা জন্ম নেয়—সাফল্যই শেষ কথা, সেই সাফল্য কীভাবে অর্জিত হলো তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই মানসিকতা শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন প্রভাব ফেলে, তেমনি পরবর্তী সময়ে কর্মজীবন ও সামাজিক জীবনেও অনৈতিক আচরণকে উৎসাহিত করে।

শিক্ষার্থীরা শুধু পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই শেখে না; সমাজ থেকেও শেখে। আমাদের সমাজে যখন তারা দেখে—অসততা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা অনৈতিক আচরণ অনেক সময় পুরস্কৃত হয়—তখন পাঠ্যবইয়ের নৈতিক শিক্ষা তাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। একদিকে শ্রেণিকক্ষে সততার কথা বলা হয়, অন্যদিকে বাস্তব জীবনে অসৎ লোকের সাফল্য দেখা যায়। এই দ্বৈত বার্তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর নৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করে।রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এই সংকটের প্রভাব রয়েছে। যদি প্রশাসন, রাজনীতি ও কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতার চর্চা দুর্বল হয়, তবে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মূল্যবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা একা সফল হতে পারে না। কারণ শিক্ষার্থীরা শেষ পর্যন্ত বাস্তব সমাজ থেকেই তাদের আচরণের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব শুধু পাঠ্যবই পড়াবে ও পরীক্ষা নেবে এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো চরিত্র গঠনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। কারণ চরিত্র এমন সম্পদ যেটা অর্থ দিয়ে কেনা যায় না। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকে পরীক্ষামুখী পাঠদানে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কও অনেক সময় আনুষ্ঠানিক ও যান্ত্রিক হয়ে পড়ে, যেখানে আদর্শ, মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলি শেখার সুযোগ সীমিত।বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই সংকট আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এখান থেকেই ভবিষ্যতের শিক্ষক, প্রশাসক, অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারক তৈরি হয়। যদি এই স্তরে নৈতিকতা, পেশাগত সততা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তি মজবুত না হয়, তবে তার প্রভাব পড়ে পুরো জাতির ওপর। দক্ষ কিন্তু মূল্যবোধহীন গ্র্যাজুয়েট একটি সমাজকে প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে নিতে পারে, কিন্তু ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।

এই ঘোর অন্ধকার বাস্তবতার মাঝে আশার আলো রয়েছে। দেশের কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার প্রসারে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমার কর্মস্থল এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এ সকল বিভাগে ইথিকস কোর্স পড়ানো হয়। যা প্রতিটি শিক্ষার্থীর মেধা মননের সৃষ্টির পাশাপাশি জগতের সামগ্রিক চারিত্রিক নীতিমালা শিখায়।এই কোর্সগুলোর উদ্দেশ্য শুধু পরীক্ষায় পাশ করানো নয়; বরং শিক্ষার্থীদের নৈতিক ভিত্তি তেরী, পেশাগত সততা সৃষ্টি, সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক আচরণ ও দেশপ্রেম সম্পর্কে সচেতন করা। শ্রেণিকক্ষে বাস্তব জীবনের নৈতিক দ্বন্দ্ব, পেশাগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিলতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে আলোচনা শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও বিবেককে নাড়া দেয়। এতে তারা বুঝতে শেখে—দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সাফল্যের ভিত্তি হলো সততা ও নৈতিকতা।এই ধরনের উদ্যোগ প্রমাণ করে যে, চাইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিতভাবে মূল্যবোধ শিক্ষাকে কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এটি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।

শিক্ষায় মূল্যবোধের সংকট কোনো একক পদক্ষেপে দূর করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ।পরিবারকে নৈতিক শিক্ষার মূল কেন্দ্র হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ, সামাজিক সেবা ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে বাধ্যতামূলকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।শিক্ষকদের নিজেদের আচরণে সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও দায়িত্ববোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শিক্ষানীতিতে নৈতিক ও নাগরিক শিক্ষাকে আরও কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং সমাজে সততার চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষায় মূল্যবোধের সংকট মূলত আমাদের সমাজের নৈতিক অবস্হার চিত্র। এই সংকট উপেক্ষা করলে আমরা হয়তো দক্ষ জনশক্তি পাব, কিন্তু মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ হবে না। জ্ঞানসম্পন্ন কিন্তু মূল্যবোধহীন মানুষ নয়—নৈতিকতা, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধে সমৃদ্ধ প্রজন্ম গড়ে তোলাই হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্য। তবেই আমরা একটি সুশীল, ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই বাংলাদেশ নির্মাণ করতে সক্ষম হবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *