উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা— এই দুই শব্দের মধ্যেই একটি জাতির ভবিষ্যৎ লুকিয়ে থাকে। জ্ঞান উৎপাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা কি সেই প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছে? বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিছু অর্জনের পাশাপাশি সীমাবদ্ধতাও কম নয়।
গত দুই দশকে দেশে উচ্চশিক্ষার বিস্তার চোখে পড়ার মতো। ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় দেড় শতাধিক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকার বেড়েছে, এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, এই বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গুণগত মান ও গবেষণার সংস্কৃতি কতটা বিকশিত হয়েছে?
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা এখনো ডিগ্রি-কেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীরা দ্রুত সনদ অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, আর অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী সংখ্যার দিকেই বেশি মনোযোগী। ফলে গবেষণা, উদ্ভাবন ও সমালোচনামূলক চিন্তার জায়গাটি দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে হওয়ার কথা নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র, সেখানে তা অনেক সময় পাঠ্যবইনির্ভর শ্রেণিকক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।
গবেষণার ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো আরও প্রকট। ২০২৫ সালেও বাংলাদেশ গবেষণা ও উন্নয়ন (আর অ্যান্ড ডি) খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ০.৩০ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে পারছে না, যা বৈশ্বিক মানদণ্ডের তুলনায় অত্যন্ত কম। উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো যেখানে জিডিপির ১–২ শতাংশ বা তার বেশি গবেষণায় বিনিয়োগ করে, সেখানে আমাদের এই সীমিত ব্যয় গবেষণার অবকাঠামো, ল্যাব সুবিধা ও মানসম্মত প্রকাশনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এ ছাড়া শিক্ষকদের অতিরিক্ত পাঠদানের চাপ, প্রশাসনিক দায়িত্ব এবং গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও প্রণোদনার অভাব গবেষণাকে অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছে। ফলে গবেষণা অনেক সময় পদোন্নতি বা ডিগ্রি অর্জনের শর্ত পূরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যার গুণগত মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
গবেষণা ও সমাজের বাস্তব সমস্যার মধ্যকার সংযোগও দুর্বল। দারিদ্র্য, বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য, শ্রমবাজার ও সামাজিক পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গবেষণা হলেও তার ফল নীতিনির্ধারণে খুব কমই প্রতিফলিত হয়। এর ফলে গবেষণার সামাজিক উপযোগিতা নিয়ে সংশয় তৈরি হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে উচ্চশিক্ষার প্রতি আস্থা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তবে এই চিত্র পুরোপুরি হতাশাজনক নয়। ইতিবাচক দিক হলো ধীরে ধীরে গবেষণার পরিসর বাড়ছে। ২০২৪–২৫ সালে বাংলাদেশি গবেষকদের আন্তর্জাতিক সূচকভুক্ত প্রকাশনার সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি, যা আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি নির্দেশ করে। যদিও এই সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে মাঝামাঝি অবস্থান নির্দেশ করে, তবু এটি গবেষণার প্রতি আগ্রহ বাড়ার একটি ইঙ্গিত।
একই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা ও সমাজসংযুক্ত গবেষণার প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। বর্তমান আমার কর্মস্থল এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশে এ প্রবণতা লক্ষণীয়। শিক্ষার্থীদের স্থানীয় সমাজের বাস্তব সমস্যা নিয়ে ক্ষুদ্র গবেষণা, ফিল্ডওয়ার্ক ও সেমিনারভিত্তিক কাজের মাধ্যমে গবেষণায় আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত। উচ্চশিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পাঠ্যক্রমের আধুনিকায়ন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল সমাজ ও পরিবেশ সংকট এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের পাঠ্যক্রম এখনো অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে।
ফলে, ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো একটি গবেষণাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। এর জন্য রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন— প্রথমত, গবেষণা তহবিল বৃদ্ধি ও তার স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও প্রণোদনা। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও যৌথ গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণ। চতুর্থত, শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণা আগ্রহ তৈরি করার জন্য প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপ জোরদার করা।
একই সঙ্গে নৈতিক গবেষণা চর্চা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবমিলিয়ে বলা যায়, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ভবিষ্যৎ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে। আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়কে কেবল চাকরির প্রস্তুতির প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখব, নাকি সমাজ পরিবর্তনের জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলব, এই সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামীর পথ। বাস্তবতার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। গবেষণাকে কেন্দ্রে রেখে, সমাজের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে উচ্চশিক্ষার পথ।
- মো. আসিফ হাসান রাজু, শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ
- এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ








