একবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা ও প্রযুক্তির সম্পর্ক এখন অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির সংযোজন একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। কিন্তু এই পরিবর্তন কি কেবলই নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে, নাকি কোনো গভীর সংকটেরও জন্ম দিচ্ছে? ২০২৬ সালের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি। ২০২৪-২৫ সালের বাস্তবমুখী পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডিজিটাল বিপ্লবের সুফল সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে না।
ডিজিটাল বিপ্লব ও বৈশ্বিক এডটেক (EdTech) বাজারের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), স্মার্ট ক্লাসরুম এবং গ্যামিফাইড লার্নিং টুলসের মাধ্যমে শিক্ষা এখন অনেক বেশি ইন্টারঅ্যাকটিভ হয়ে উঠছে। ব্যক্তিগতকৃত শিখন পদ্ধতি বা Adaptive Learning এখন আর স্বপ্ন নয়, বরং এটি শিক্ষার্থীদের মেধা অনুযায়ী পাঠদানের এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের এডটেক বাজারের বর্তমান আকার ৩৫৮.৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০২৪)। ২৪.৪২% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি (CAGR) হারে এটি ২০৩৩ সাল নাগাদ ২.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে যে, লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (LMS) এবং ডিজিটাল কন্টেন্টের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে।
ডিজিটাল বিভাজন: সংকটের রূপরেখা ও কঠিন বাস্তবতা
সম্ভাবনার পাশাপাশি ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বা ডিজিটাল বিভাজন এখন এক প্রকট সংকট। ২০২৪-২৫ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের উপাত্ত অনুযায়ী, শহরের প্রায় ৭১.৪ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও গ্রামাঞ্চলে এই হার মাত্র ৩৬.৫ শতাংশ। এই ব্যবধান শিক্ষা ক্ষেত্রে এক চরম বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে। গ্রামের একজন শিক্ষক যেখানে পর্যাপ্ত ল্যাব বা ইন্টারনেটের অভাবে মানসম্মত পাঠদান করতে পারছেন না, শহরের শিক্ষার্থী সেখানে এআই টিউটর ব্যবহার করছে। ফলে উচ্চশিক্ষার সমান সুযোগ ব্যাহত হচ্ছে। অর্থাৎ, গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক পিঁছিয়ে আছে। এই বিভাজন কেবল ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নয়, বরং ডিজিটাল শিক্ষার মানের ক্ষেত্রেও এক বিরাট ব্যবধান তৈরি করছে।
শিক্ষক ও অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ : সম্ভাবনা ও শঙ্কা
প্রযুক্তির টুলস বাড়লেও দক্ষ জনশক্তির অভাব এখনো কাটেনি। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং প্রযুক্তিতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব আধুনিক শিক্ষাদানকে বাধাগ্রস্ত করছে। পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা, উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং স্মার্ট ডিভাইসের উচ্চমূল্য এখনো একটি বড় অন্তরায়। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি এবং এআই-নির্ভরতার ফলে তাদের সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এআই-এর মাধ্যমে ‘পার্সোনালাইজড লার্নিং’ বা মেধাভিত্তিক ব্যক্তিগত পাঠদান সম্ভব হলেও, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল দক্ষতার অভাব এবং শিক্ষকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ঘাটতি এক নতুন দুশ্চিন্তার জন্ম দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারের আত্মবিশ্বাস এখনো মধ্যম পর্যায়ে সীমাবদ্ধ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও এআই-এর ভবিষ্যৎ
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের কোডিং, ডাটা অ্যানালিটিক্স এবং এআই ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা এখন সময়ের দাবি। ২০২৫ সালের মধ্যে আইসিটি খাতের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করেছে, তা অর্জনে উচ্চশিক্ষায় প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ অপরিহার্য। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘স্মার্ট এডুকেশন রোডম্যাপ ২০৪১’ (যার অন্তর্বর্তীকালীন লক্ষ্য ২০৩১) মূলত প্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার পরিকল্পনা, সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন একটি কেন্দ্রীয় লক্ষ্য। । এই রোডম্যাপের মূল মন্ত্র হলো এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা, যেখানে প্রযুক্তি কেবল একটি মাধ্যম নয়, বরং শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে। ২০৩১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি জ্ঞানভিত্তিক ‘স্মার্ট জাতি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে এগিয়ে যাবে।
উপসংহার ও উত্তরণের পথ
এই প্রযুক্তিগত রূপান্তরকে সফল করতে হলে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আরএন্ডডি (R&D) খাতে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। ২০৩১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্বপ্ন পূরণে ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য হ্রাস এবং গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন এখন প্রধান দাবি। প্রযুক্তি কোনো সমস্যা নয়, ব্যবহারের অসাম্যতা ও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবই হলো আসল সংকট।
পরিশেষে বলা যায়, প্রযুক্তি নিজে কোনো সমাধান নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এই হাতিয়ারকে সংকটের পরিবর্তে সম্ভাবনা হিসেবে কাজে লাগাতে হলে আমাদের ডিজিটাল অবকাঠামোর বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ জোরদার করা এবং শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার শেখানোই হবে আগামীর চাবিকাঠি। সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আমরা যদি সঠিক পরিকল্পনায় এগোতে পারি, তবেই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা এক অপরাজেয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে।
তথ্যসূত্র ও রেফারেন্স:
১. Bangladesh Bureau of Statistics (BBS), ICT Survey 2024-25.
2. IMARC Group, Bangladesh EdTech and Smart Classrooms Market Report 2024.
3. UNESCO, Digital Development in South Asian Education (2025).
4. Ministry of Education, Smart Education Roadmap 2031.
লেখক: আবদুল্লাহ রকিব আকন্দ
প্রভাষক, সিএসই বিভাগ
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ








