শিক্ষা কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়; এটি একটি সমাজের ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রধান সূচক। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG-4) অনুযায়ী—“সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সংগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা”—আজকের বিশ্বে একটি সর্বজনস্বীকৃত অঙ্গীকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি বাস্তবে শিক্ষায় সমতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পেরেছি?
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা বিস্তৃত একটি ধারণা। এর অর্থ হলো—কোনো শিক্ষার্থী যেন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, মানসিক অবস্থা, সামাজিক পরিচয় বা অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে ছিটকে না পড়ে। প্রতিবন্ধী শিশু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী, বস্তিবাসী শিশু কিংবা কর্মজীবী দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য মূলধারার শিক্ষা এখনও অনেক ক্ষেত্রে অধরা। যদিও নীতিগতভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার কথা বলা হয়, বাস্তবে শ্রেণিকক্ষ, পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষাব্যবস্থা অধিকাংশ সময়েই তাদের উপযোগী নয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষায় প্রবেশাধিকার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে—প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি, নারী শিক্ষার অগ্রগতি এবং সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির মতো সাফল্য আমাদের অর্জন আছে। তবু এই পরিসংখ্যানের আড়ালে রয়ে গেছে গভীর বৈষম্য। শহর ও গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থার মানগত পার্থক্য(২০২০ সালের ‘Bangladesh Education Fact Sheets’ অনুযায়ী, গ্রামীণ এলাকায় বাল্যশ্রমের হার বেশি, যা শিক্ষার মানের উপর প্রভাব ফেলে), দরিদ্র ও ধনীর শিক্ষার সুযোগের ফারাক(Oxfam-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, দরিদ্র শিশুরা ধনী শিশুদের তুলনায় ৭ গুণ কম স্কুল শেষ করে, অর্থাৎ তাদের স্কুল ছাড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ), প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রান্তিক অবস্থান (পরিসংখ্যান -বিবিএস জরিপ, ২০২১: ৫-১৭ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে মাত্র ৬৫% প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং ৩৫% মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত। মোট ৬০% প্রতিবন্ধী শিশু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে। ) এবং নৃগোষ্ঠী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত বঞ্চনা—(জনগণনা জরিপ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাক্ষরতার হার ৪৩.৯ শতাংশ, যা জাতীয় হার হতে ৭.৯ শতাংশ কম এবং চট্টগ্রাম বিভাগে হার থেকে ৮.৮ শতাংশ কম (জাতীয় হার ৫১.৮% এবং চট্টগ্রাম বিভাগের হার ৫২.৭%)।এসবই শিক্ষায় সমতা অর্জনের পথে বড় অন্তরায়।
সমতা মানে সবাইকে এক জিনিস দেওয়া নয়; বরং যার যা প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করা। অথচ আমাদের শিক্ষা নীতিতে এখনো “এক ছাঁচে সব” ভাবনা প্রবল। একই পাঠ্যক্রম, একই মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং একই শিক্ষণ কৌশল—সব শিক্ষার্থীর জন্য প্রযোজ্য বলে ধরে নেওয়া হয়। এর ফলে শারীরিক প্রতিবন্ধী, শিখনে ধীরগতি সম্পন্ন, ভাষাগত সংখ্যালঘু কিংবা সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা প্রায়শই ব্যবস্থার বাইরে ছিটকে পড়ে।
অন্যদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ নয়; এটি নিরাপদ, সম্মানজনক ও সহানুভূতিশীল শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রশ্ন। বিদ্যালয়ে বুলিং, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক ভিন্নতার প্রতি অসহিষ্ণুতা—এসব বিষয় শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েশিশু, তৃতীয় লিঙ্গ, প্রতিবন্ধী বা দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে অদৃশ্য বৈষম্যের শিকার হয়।
ডিজিটাল শিক্ষার প্রসারও একদিকে যেমন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, অন্যদিকে তেমনি ডিজিটাল বিভাজন নতুন বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। কোভিড-পরবর্তী সময়ে অনলাইন শিক্ষায় যারা স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও সহায়ক পরিবেশ পেয়েছে, তারা এগিয়ে গেছে; আর যারা পায়নি, তারা আরও পিছিয়ে পড়েছে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরেই এক নতুন শ্রেণিভেদ তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ—তিন পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য। প্রথমত, নীতি পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা জরুরি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষক প্রশিক্ষণে বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রেণিকক্ষ পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের মানসিকতা ও দক্ষতা দুটোই গড়ে তুলতে হবে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনা ও সংবেদনশীলতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, মূল্যায়ন ব্যবস্থায় নমনীয়তা আনতে হবে, যাতে কেবল মুখস্থবিদ্যা নয়, সক্ষমতা ও সৃজনশীলতাও গুরুত্ব পায়। চতুর্থত: অবকাঠামো ও সহায়ক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে—বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে।
শিক্ষায় সমতা ও অন্তর্ভুক্তি কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়—এটি একটি সামাজিক নৈতিকতা। পরিবার, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ যদি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতন ভূমিকা না নেয়, তবে কোনো নীতিই কার্যকর হবে না। শিক্ষা তখনই প্রকৃত অর্থে মুক্তির পথ হবে, যখন তা কাউকে বাদ না দিয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগোবে। শিক্ষায় সমতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা মানে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের ভিত শক্ত করা। এই প্রশ্নের উত্তর আমরা কীভাবে দিই—তার ওপরই নির্ভর করবে আমাদের আগামী প্রজন্ম কতটা মানবিক, সহনশীল ও আলোকিত হবে।
- নিঘাত সুলতানা
সহকারি অধাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ








