মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

‘আপনাকে স্বাগতম, তবে সমালোচনা করার সুযোগ দিন’

তারেক রহমান

দেড় যুগের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে জন্মভূমিতে ফিরছেন, এ জন্য আপনাকে (তারেক রহমান) এবং আপনার পরিবারকে স্বাগত। তাই বলে ভাববেন না, আপনার জন্য এই দেশের সব মানুষ মুখিয়ে আছে। তবে নিরাশ হবেন না, এই কারণে যে, পুরো জাতি আপনার বিরুদ্ধে তা কিন্তু নয়? অর্থাৎ দেড় যুগের নির্বাসিত জীবনকে কাজে লাগানোর যে সুযোগ, সেটিকে যদি কাজে লাগাতে পারেন তাহলে আপনি হবেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ জন্য আপনার আগমনকে দল এবং দেশের মানুষ ভিন্ন চোখে দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। আপনাকে ঘিরে পরতে পরতে পারদ থাকবে জন্মভূমিতে পা ফেলার আগ পর্যন্ত। অনেকটা আশির দশকে ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনির নির্বাচিত জীবন শেষে দেশে ফেরার বেলায় যেমনটা হয়েছিল।

একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে আপনি যখন দেশ ছাড়েন, তখন এই দেশকে দেখে গেছেন একরকম। আর দেড় যুগে কতটা বদলে গেছে, সেটি হয়তো ভিন দেশ থেকে দেখেছেন বা শুনছেন। এই গত ক’বছরে বাংলাদেশের মানুষ গতি-প্রকৃতি বদলেছে, রাজনীতি বদলেছে। এমনকি গ্রামের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষের হাতেও এখন অ্যানড্রোয়েড ফোন এসেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে নিজেকে বদলে যাওয়ার সফল সম্ভাবনাকে সঠিক কাজে লাগাতে না পারলেও গুজব আর গজবে একাকার পুরো দেশ। যখন-তখন যাকে-তাকে শুয়ে দেয়ার কালচার আরও বেড়েছে।

একসময় পক্ষ-বিপক্ষ পাশাপাশি মিছিল করলেও বাধা আসেনি বা দেয়নি। দেড় যুগে রাজনীতি অনেকটা ঘরবন্দি ছিল। সেটি আপনার দল ছাড়াও অন্যরা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে। কঠিন সেই পরিস্থিতিতে যারা রাজনীতি করেছেন, তাদের অনেকেই কোণঠাসা। ত্যাগীরা সুযোগসন্ধানীর চাপে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। কালো টাকাওয়ালারা নতুন করে কাঁধে চেপে বসছে। কেউ সুযোগ খুঁজছে।

তৃতীয় বিশ্বের এই দেশটি সবাই খুবলে খেতে চায়। যেমনটা ব্যুরোক্র্যাট থেকে শুরু করে, চেয়ারে বসা রাজনৈতিক ব্যক্তি, পদ-পদবিরোধী নেতা, দলছুট বা সুযোগসন্ধানী নেতা তথা জি হুজুর পার্টি। এমনকি সাংবাদিকতার নামে কথিত চাটার দলও। ফলে দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও বারবার হোঁচট খেতে হয়। এটি আপনার বেলায়ও হবে না, তা বিশ্বাস করি না। তবে সতর্ক থাকতে হবে এবং আপনি যদি অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং অমর হতে চান, তা হলে চামবাজি-দুর্নীতিসহ সব অন্যায় শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। সেটি না করতে পারলে সামনে আপনার জন্যও বিপদ অপেক্ষা করছে। তা কিছুটা টের পেয়েছেন বলেই হয়তো একাধিকবার সতর্কবাণী দিয়েছেন।

দীর্ঘ প্রবাসজীবনে ব্রিটিশদের জীবনযাপন, নিয়মানুবর্তিতা এবং আইনের প্রয়োগ রপ্ত করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ। কিন্তু এই দেশ কতটা বিশৃঙ্খল তাও আপনার জানা। তার ওপর দেড় যুগের একটা জগদ্দল পাথর রাষ্ট্রের অনেক কাঠামো ভেঙে দিয়ে গেছে। শিখিয়ে গেছে রাজনীতির নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা রাষ্ট্রকে ব্যবহার। দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ দিলেও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকে পুরস্কৃত করার সংস্কৃতি এই দেশে। কারণ, এত মানুষের দেশে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা, সেটি বের করাও কঠিন। তার ওপর স্বার্থবাদিরা তদবিরের ঝাঁপি নিয়ে সত্যকে মিথ্যা বানানোর পাল্লা ভারী করে। ফলে অধস্তনদের বিশ্বাস করে অনেক কিছু করতে হয়। সেটি করতে গিয়ে অনেক সময় ডুবতে হয়। দায় নিতে হয় শীর্ষ ব্যক্তিকে।

এ কারণে রাষ্ট্র কাঠামোর এই জায়গাটিতে শক্ত যেমন হতে হবে, তেমনি দক্ষতা, সততা এবং পরীক্ষিত বিশ্বস্ত লোকও লাগবে। এই বিশ্বস্ত লোকের মিছিল এখন অনেক বড়। সবাই এখন আপনার লোক হতে ভিড় করছে। বিপদ দেখলে এরাই আবার সবার আগে গোল্লাছুট দেবে। বিশেষ করে সাংবাদিকতার নামে জি হুজুর কালচারে কীভাবে ডুবিয়ে দেয়া যায়, সেটাও হয়েছে আপনার জন্মভূমি এই দেশে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তো সমালোচনা শুনতেই পেত না। কেউ তাকে নিয়ে সমালোচনা করলে আইনের খড়গে জীবন তছনছ হয়ে যেত। যে কারণে সমালোচনা করতে পারে, এমন কাউকে তখন দাওয়াত দেয়া হতো না। যারা দাওয়াত পেতেন, তাদের আগাম প্রশ্নও জমা দেয়া লাগত।

এমন জি হুজুর আপনার বেলায়ও হোক, আমি তা চাই না। আপনার দরবারে আমাকে দাওয়াত দিন আর না দিন, আমি যেন সত্যটা বলতে পারি সেই নিশ্চয়তা চাই। না হলে একসময় দেশ ছেড়ে চলে যাব। তারপরও চুপ থাকতে পারব না কিংবা আবারও দেশ রসাতলে যাক, সেটি মেনে নেয়া কঠিন। জেলে দেন আর ভয় দেখান, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আমি তথ্যভিত্তিক সত্যটা বলতে চাই―এটাই আমার চাওয়া।

আমি চাই সঠিক সমালোচনা করার সুযোগ দিন। দুর্নীতি-অপরাধ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে তথ্য-প্রমাণসহ সংবাদ প্রকাশিত হলে, জড়িত ব্যক্তি আপনার দলের কেউ হলেও তার বিরুদ্ধে ত্বরিত অ্যাকশন নিন। কারণ, সঠিক সমালোচনা ব্যক্তিকে পরিশুদ্ধ করে। অন্তত ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে যেভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে, সেটি হওয়া লাগবে না।

এছাড়া বিনীত অনুরোধ, প্রকৃত গণমাধ্যমের হাত-পা বাঁধবেন না। দলের কারও বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণসহ প্রতিবেদন হলে অ্যাকশন না নিয়ে উল্টো চটে যাবেন, সেটাও এই প্রজন্ম মানবে বলে মনে হয় না। তবে এটাও সত্য, এই দেশে মিথ্যাকেও এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন সেটি-ই সত্য। এ জন্য দরকার হলে নিজের মতো করে যাচাই করে নেবেন। ভিন দেশে বসে সত্য-মিথ্যার ফুলঝুরি মিশিয়ে বানানো গোবলেটের গুজবেও একাকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। অর্থাৎ, প্রযুক্তির যুগে পদে পদে যেমন সুযোগ, তেমনি পদে পদে বিপদও।

বাংলাদেশের গরিব-দুঃখী মানুষগুলো স্বাধীনতার পর থেকে ঢেউয়ের মতো ভাসছে। এ দল বলছে, ওই দল খারাপ আর ওই দল বলছে এ দল খারাপ। এই ধাক্কাধাক্কিতে সাধারণ মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন হয়নি। একইভাবে রাজনীতির নামে হানাহানি, শত্রুতা দেড় যুগ আগেও এতটা ছিল না। এমন পরিস্থিতি পুরো জাতিকে আতঙ্কে ফেলে দিয়েছে।

নিরাপত্তা এই দেশে অনেকটা আকাশের চাঁদের মতো। গত এক যুগে অসংখ্য তরুণ লেখাপড়ার নামে দেশ ছেড়েছেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে দেশ ছেড়েছেন এমন সংখ্যাও কম নয়। এর কারণ দেশের রাজনীতি। অথচ রাজনীতি জনকল্যাণের জন্য, দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ভিনদেশে পাচার হয়েছে। জেনেও তা আটকানো হয়নি, অপশাসনের কারণে। বিচারব্যবস্থা, সশস্ত্র বাহিনী, শিক্ষা এমনকি গোয়েন্দা সংস্থাও আজ্ঞাবহ ছিল। জি হুজুরের যুগে বদলে যাওয়া নতুন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আপনি হয়তো পরিচিত নন।

লন্ডনের মতো দেশে থেকে এটা সম্ভবও নয়। তবে ভিনদেশে যাওয়ার আগে আপনাকে ঘিরে যারা বিশেষ বলয় গড়ে তুলেছিল, তারা কীভাবে আপনাকে অন্ধকারে রেখে ফায়দা হাসিল করেছে, সেটি অবশ্যই ভুলে যাননি। যার কারণে আপনি, আপনার মা এবং দলও ক্ষতিগ্রস্ত। যদিও পুরনো সেই পথকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন, এমনটি শোনা যায়। কিছুটা বোঝাও যায়, যারা আপনার দুঃসময়ের জন্য দায়ী, তাদের দূরে থাকতে দেখে। তাই সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে সামনের দিকে পথ চলবেন। কারণ, সঠিক নেতৃত্ব এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে আপনিও হারিয়ে যাবেন। সঙ্গে হারাবে এই দেশ এবং জাতির ভবিষ্যতও। আপনার মা খালেদা জিয়া এই দেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য কী না করেছেন? তার সম্মানে অন্তত ভালো কিছু করবেন, এই প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *